দখিনের খবর ডেস্ক ॥ করোনা ভাইরাস গোটা বিশ্বে একটি মহামারির নাম। যা চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে বিশ্বের ১৮৯ দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭ জনে। এর মধ্যে পাঁচজন সুস্থ হয়েছেন, মারা গেছেন দুইজন।
করোনা প্রতিরোধে দেশে সরকারিভাবে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে জনসমাগম এড়াতে সাধারণ মানুষকে বাড়িতে থাকার পরামর্শ দেওয়া, হাত ধোয়া ও নিয়মিত পরিষ্কার থাকার পাশাপাশি বিদেশ ফেরত নাগরিকদের হোম কোয়ারেন্টিনে রাখার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রশাসন থেকে। সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে এ ভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণ সুস্পষ্ট করা হলেও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ছেন অনেক সময়। জ্বর বা গলাব্যথা হলেই করোনা আতঙ্ক শুরু হয়ে যায় তাদের মধ্যে।
আর এ সমস্যার সমাধানে কিছু চিকিৎসক স্ব-উদ্যোগে এগিয়ে এসেছেন। কিছু চিকিৎসক তাদের ব্যক্তিগত ফোন নম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়েছেন এবং জানিয়েছেন জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথা হলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। আবার কেউ কেউ তো একত্রিত হয়ে টিমওয়ার্ক শুরু করে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে পরামর্শ দিতে। এরইমধ্যে সাধারণ মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে পাঁচ চিকিৎসক ও পাবলিক হেলথ এক্সপার্টদের উদ্যোগে শুরু হওয়া ২৪/৭ ডব ভড়ৎ ঢ়বড়ঢ়ষব ইু ঘঝট চঁনষরপ ঐবধষঃয উবঢ়ধৎঃসবহঃ ফেসবুক গ্রুপটি।
গ্রুপের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের মধ্যে অন্যতম বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডেন্টাল অনুষদের সাবেক ছাত্র ডা. মাহবুবুর রহমান রাজিব জানান, মাত্র চারদিন ধরে শুরু করা এ গ্রুপের যাত্রাটা কয়েকজেনের হাত ধরে হলেও এখন ৮০ জনের মতো চিকিৎসক ও পাবলিক হেলথ এক্সপার্ট রয়েছেন। যারা সর্বশেষ ৪৮টি মোবাইল নম্বর দিয়ে হটলাইনে সাধারণ মানুষদের সেবা দিচ্ছেন। যেখানে তিনদিনে তিন হাজারের ওপর মানুষের ফোনকল রিসিভ করা হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে আতঙ্ক দূর করে সরকার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী পরামর্শ দেওয়ার।
তিনি বলেন, আমাদের সিনিয়র এক আপু অলিয়া মাহজাবিনের উদ্যোগেই মূলত চিকিৎসকদের এ গ্রুপটি খোলা। শুরুতে আপুর সঙ্গে আমিসহ ডা. রেহান আখতার, ডা. নিলয় প্রসাদ চক্রবর্তী, আসাদুজ্জামান শুভ ছিল। এরপর সাহস করে গ্রুপটির যাত্রা শুরু করাই মাত্র তিনদিনে যেমন সেচ্ছাসেবী চিকিৎসকদের সংখ্যা বেড়েছে তেমনি সাধারণ মানুষের ফোনকলের পরিমাণও বেড়েছে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কলেজের সাবেক ছাত্র ডা. রেহান আখতার জানান, শুরু থেকেই আমরা বলেছি, কোনো ওষুধ দেবো না। আমরা শুধু পরামর্শ দেবো। কারণ সঠিক পরামর্শের অভাবে বেশিরভাগ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়েন। আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত রিকশাওয়ালা থেকে ধনী পর্যায়ের অনেক ব্যক্তিই ফোন দিয়েছেন। চেষ্টা করেছি তাদের সঠিক পরামর্শ দেওয়ার জন্য। যেমন কারো জ্বর হয়েছে তাকে বলেছি স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে গিয়ে সাধারণ ওষুধ ক্ষেতে। আবার কারো গলাব্যথা ও খুসখুসের কাশির সমস্যা হয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক ক্ষেতে চাচ্ছে তাকে নিষেধ করেছি। কারণ সমস্যাটা শুনে আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়েছে। তাকে গরম পানি দিয়ে গড়গড় করা ও আদা খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। তিনদিন পরে আবার যোগাযোগ করতে বলেছি।
আবার কারো জ্বর, গলাব্যথাসহ যদি আরও কিছু সমস্যা একত্রে দেখা দেয় তাদের অবস্থান বুঝে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা হাসপাতালের চিকিৎসকের পরামর্শ, নয়তো আইইডিসিআরের হেল্পলাইনের নম্বর দিয়ে কল দিতে বলেছি। এক কথায় স্বাস্থ্য বিভাগের নির্ধারিত পরামর্শগুলোর মধ্যে থেকেই আমরা সেবাটা দেওয়ার চেষ্টা করছি। করোনা ভাইরাসের সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু জ্বরের বিষয়েও সাধারণ মানুষকে পরামর্শ দিচ্ছি।
এদিকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. এস এম সরোয়ার তার ফোন নম্বরটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দিয়েছেন। সেখানে তিনি নম্বর দিয়ে লিখেছেন জ্বর-সর্দি-কাশি-গলাব্যথা হলে সরাসরি কোনো চিকিৎসকের কাছে যাবেন না। আমাকে বা যেকোনো ডাক্তারকে ফোন করুন।
একই হাসপাতালের মেডিসিন বহিঃবিভাগের মেডিক্যাল অফিসার ডা. মোস্তফা কামাল তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, জ্বর-সর্দি-কাশি-গলাব্যথা হলে হাসপাতালে যাবার প্রয়োজন নেই। বাসায় থাকেন, হাইজেন মেন্টেইন করেন। আর প্রয়োজন হলে দিনে তিন বেলা নাপা ট্যাবেলট ও রাতে একটি করে রুপা ১০ মিলিগ্রামের একটি ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দেন। আর প্রয়োজনে তার নম্বরে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
একইভাবে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেডিক্যাল অফিসার ডা. নাহিদ হাসান তার ফোন নম্বরটিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়েছেন এবং তিনিও জ্বর-সর্দি-কাশি-গলাব্যথা হলে সরাসরি কোনো চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে তাকে বা অন্য কোনো চিকিৎসককে ফোন দেওয়ার জন্য বলেছেন। পোস্ট দু’টি নিয়ে এরইমধ্যে হইচই পড়ে গেছে ডাক্তার পাড়ায়। তাদের দু’জনকে সাধারণ মানুষের সেবায় এভাবে এগিয়ে আসার জন্য গর্ববোধ করার পাশাপাশি ধন্যবাদ জানিয়েছেন অনেকেই।
এছাড়া শেবাচিম হাসপাতালের সাবেক শিক্ষার্থী ও প্রগতিশীল চিকিৎসক ফোরামের ডা. মনীষা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একটি মেডিক্যাল টিম সাধারণ মানুষের সেবায় কাজ শুরু করেছে। যারা একটি হেল্পলাইনও চালু করেছেন। ডা. মনীষা চক্রবর্তী জানিয়েছেন, হেল্পলাইনে পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি সরাসরিও রোগী দেখা শুরু করেছেন তিনি। বেশ সাড়াও পড়েছে এ কাজটিতে। প্রতিদিন প্রচুর মানুষ সেবা নিচ্ছেন তাদের মাধ্যমে।
সার্বিক বিষয়ে বরিশাল বিভগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার দাস বলেন, এটি সত্যিই ভালো ও মহৎ উদ্যোগ। এর ফলে মানুষ সঠিক সিদ্ধান্তটা বাসায় বসে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেই নিতে পারছেন। অযথা সুস্থ রোগীকে ঝুঁকি নিয়ে হাসপাতালে আসতে হবে না। ফলে হাসপাতালগুলোতে জনসমাগমও কমছে।
Leave a Reply